আমার শিক্ষা ভাবনা: ড. মোঃ শরিফুল ইসলাম

- আপডেট সময় : ০৯:১৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫ ২৩৮ বার পড়া হয়েছে
আমার ওয়াইফ একটি সরকারি কলেজের বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) ছিলেন । সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় প্রায় সব শিক্ষার্থী বিদেশের যাত্রী। ফোন আসে প্রায়ই অধ্যয়নরত সনদের জন্য। তিনি বললেন, অনার্সের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। কেউ বিদেশ গেছে, কোন মেয়ের বিয়ে হয়েছে, কেউ সংসারের হাল ধরেছে। কোন শিক্ষার্থী এমনও আছে ৪র্থ বর্ষের সব পরীক্ষা শেষে শুধু ভাইভা বাকী রেখে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। তার কিন্তু এই ৪ বছরের কোন মুল্যায়ণ হলো না, বিষয়টি আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে।
আমাদের দেশে রয়েছে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার। অপরদিকে ভারতের অনেক হিন্দু শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় শিক্ষার্জন করে, আরবি ভাষা শিক্ষা করে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার দখল করে রেমিট্যান্স চ্যাম্পিয়ন হয়। অপরদিকে আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শিক্ষার্জন করে বিদেশে গিয়ে DC ( পরিচ্ছন্ন কর্মী) হয়। তাই আমাদের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তাদের আমার নিম্নোক্ত ভাবনাগুলো নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করার জন্য পেশ করছি।
(১) যে কোন মুল্যে মেধা পাচার রোধ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হয়েও তারা অনুন্নত। আবার প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর শুধু মেধা লালন করে তারা বিশ্বসেরা। সম্পদ এক সময় শেষ হতে পারে, কিন্তু মেধার পরিচর্যা, লালন ও যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে বাড়তে থাকে। বিশ্বসেরা যেসব বাংলাদেশী এখন বিদেশে আছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিবছর ৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী বিদেশে যায়, এর ৮০% আর ফিরে না। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই Brain drain
ই হলো উন্নত দেশের এক ধরনের Intellectual war বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ।
(২) শিক্ষার সব স্তরে স্ব স্ব ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামুলক করতে হবে। কেননা ধর্ম নৈতিকতা শিক্ষা দেয়।
২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত ‘গ্যালোপ জরিপ’ এ “ধর্ম কি তোমার প্রতিদিনের জীবনে গুরুত্ব বহন করে?” এতে বাংলাদেশী ৯৯%+ উত্তরদাতা ‘হ্যা’ জবাব দেন।
* Duke of Wellington. বলেন, If you teach your children the three R’s (reading, wrighting & arithmatic ) and leave the great “R” (Religion), you will produce a fourth R (Rascaldom) & get a nation of cunning devils”. —– Duke of Wellington.
তাহলে বুঝা গেল একটি সুশিক্ষিত, উন্নত ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ জাতি গঠনে স্ব স্ব ধর্মীয় শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
(৩) স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি স্তরের মাধ্যমিক বা সমমান লেভেলে কর্মমুখী শিক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাস শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ঐ শিক্ষার্থী ফেল করলেও একটি কাজ শিখে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে।
(৪) বিদ্যমান পলিটেকনিক /সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৪ বছরের ডিপ্লোমাকে ৫ বছরে উন্নীত করে স্নাতক পাশ কোর্সের মান দেওয়া যেতে পারে। ২ বছর শেষ করলে HSC মান দেওয়া যেতে পারে।
(৫) ৪ বছর মেয়াদী অনার্সের ১ বছর শেষে ‘সার্টিফিকেট’ সনদ, ২ বছর শেষ করলে ‘অনার্স ১ম পর্ব’, ৩ বছর শেষ করলে ‘স্নাতক পাশ’ ও ৪ বছর শেষ করলে ‘অনার্স সমাপনী’ সনদ দেওয়া যেতে পারে। যাতে কারো শ্রম বৃথা না যায়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনার্স ১ বছর শেষ করলে ‘সার্টিফিকেট’ সনদ, ২বছর শেষ করলে ‘ডিপ্লোমা’ সনদ, ৩বছর শেষে ‘ডিগ্রি’ সনদ ও ৪বছর সফলভাবে শেষ হলে ‘অনার্স’ সনদ দেওয়া হয়। এভাবে অনার্সে ৪ বছরে ৪টি সনদ তারা পায়। অর্থাৎ যে যতটুকু সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছে, তার কাটায় কাটায় মুল্য পায়। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে। তারা পারলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?
(৬) একাডেমিক লোড নিয়ে ৪ বছরের কোর্স ৩ বছরে শেষ করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এবং উহা ১ম বছরের পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করবে।
(৭) নতুন ৩ শতাধিক সরকারি কলেজে স্নাতক কোর্সের প্রতি বিষয়ে ১ জন এম,ফিল বা সমমান ডিগ্রিধারী ও অনার্সের প্রতি বিষয়ে ১ জন পি-এইচ,ডি বা সমমান ডিগ্রিধারী নিয়োগ করা যেতে পারে।
ভারতের Autonomus College এ একটি বিভাগে ১৫ জন শিক্ষক, সবাই ডক্টরেট ডিগ্রি ধারী। আর আমাদের দেশে? আমরা ব্যস্ত আছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে Ph.D কোর্স নিয়ে।
(৮) BCS শিক্ষায় ১০% উচ্চতর ডিগ্রিধারীর সুযোগ দেওয়া, উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে তৎকালীন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ১০ শতাংশ সরাসরি কোটায় বেসরকারি উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকবৃন্দের সরকারি কলেজে প্রবেশের পদ্ধতি চালু করে তাদেরকে সম্মানিত করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির বাধার মুখে প্রবর্তিত বেসরকারি উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের শেষ পেশাগত আশ্রয়স্থল এ সম্মানিত বিধান বা পদ্ধতিটি অনেক দিন ধরে বন্ধ আছে। এর ফলে এমপিওভুক্ত উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকবৃন্দ একদিকে যেমন সরকারি কলেজে গিয়ে পেশাগত উন্নয়ন করতে পারেননি; অন্যদিকে সরকারিভাবে পদোন্নতিসহ পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ না থাকায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তারা যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছেন না।
(৯) এম,ফিল বা সমমান ডিগ্রিধারীদের সরাসরি সহকারি অধ্যাপক ও পি-এইচ,ডি বা সমমান ডিগ্রিধারীদের সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করা যেতে পারে।
(১০) এমপিওভুক্তি যে তারিখেই হোক, যোগদান থেকে অভিজ্ঞতা গণনা করতে হবে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এ ব্যাপারে একটি রায় দিয়েছে। আমরা আশা করব বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার কোর্টের প্রতি সম্মাণ প্রদর্শন করে দাবীটি মেনে নেবেন।
(১১) স্রষ্টা তার সৃষ্টিকুলের জন্য অপরিহার্য উপাদান পানি, বাতাস, আলো, অক্সিজেন সবই ফ্রি দিয়েছেন। তাই রাষ্টেরও উচিত সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে ‘জাতীয়করণ’ করা।
————-
ড. মোঃ শরিফুল ইসলাম
গবেষক ও কলামিস্ট, সিলেট
dr.1979sharif@gmail.com