পঞ্চম শ্রেণি শেষে বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর খসড়া নীতিমালা শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

- আপডেট সময় : ০৮:৪৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫ ১৪৪ বার পড়া হয়েছে
পঞ্চম শ্রেণি শেষে বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর খসড়া নীতিমালা শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। বাড়ছে টাকার পরিমাণও।
পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার পর একসময় বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। তাতে উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে মেধাতালিকায় জায়গা পাওয়াদের দেওয়া হতো মাসিক হারের বৃত্তির টাকা। ২০০৯ সালে চালু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসিই)। সে বছর থেকে বন্ধ হয়ে যায় বহুল কাঙ্ক্ষিত বৃত্তি পরীক্ষা।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকার আবারও বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে এরই মধ্যে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে তা জমা দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। খসড়া নীতিমালা নিয়ে এক দফা বৈঠকও হয়েছে। শিগগির এ নীতিমালা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। আগের নিয়মের সঙ্গে কিছু বিষয় যুগোপযোগী করে খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। তা এখন চূড়ান্তভাবে প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বৃত্তি পরীক্ষা আগের নিয়মে ফেরানোর নির্দেশনা দিয়ে অধিদপ্তরে চিঠি দেয়। পরে অধিদপ্তর দীর্ঘদিন পর বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর খবরে খুশি অভিভাবকরা। তারা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা না থাকায় সন্তানদের পড়ার টেবিলে বসানোর অভ্যাস করতে পারছেন না তারা। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। ফলে শিশু শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়েই বেড়ে উঠছে। বৃত্তি পরীক্ষা ফিরলে কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীরা ধারণা পাবে। এ বছর থেকেই বৃত্তি পরীক্ষা হবে, এটা নিশ্চিত। শিগগির বৃত্তি পরীক্ষার নিয়ম-কানুন কী হবে, তার নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়।-প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেন,২০২৫ ইং থেকেই বৃত্তি পরীক্ষা চালু করা হবে। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ডিসেম্বরের মধ্যেই এ পরীক্ষা আয়োজনে সব পদক্ষেপ নেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে, যা ২৫ শতাংশে বাড়ানোর সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর।
প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দুই ধরনের বৃত্তি দেওয়া হয়। একটি হলো—ট্যালেন্টপুল, আরেকটি সাধারণ বৃত্তি। ২০০৯ সালে সবশেষ চালু থাকা সময়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী মাসিক ৩০০ টাকা হারে বৃত্তির অর্থ পেতো। আর সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তরা পেতো ২২৫ টাকা। বৃত্তি নীতিমালা যুগোপযোগী করায় এবার টাকার পরিমাণও বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমান বাজারমূল্য ও শিক্ষা উপকরণের দাম বিবেচনায় দুই ধরনের বৃত্তির অর্থ দ্বিগুণ করার সুপারিশ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।অধিদপ্তরের বৃত্তি শাখার তথ্যমতে, খসড়া নীতিমালায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তির পরিমাণ ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তদের ২২৫ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ টাকা করার সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর। আশা করছি, শিক্ষার্থীদের বর্তমান খরচের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে বৃত্তির টাকা বাড়ানো হবে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সবশেষ আগের নিয়মে বৃত্তি পরীক্ষা হয়। সেসময় সারাদেশ থেকে ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ ক্যাটাগরিতে প্রায় সাড়ে ৮২ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। তার মধ্যে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুল ও ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন সাধারণ বৃত্তি পেয়েছিল। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক কোটা পদ্ধতিতে এ বৃত্তি দেওয়া হয়। গত ১৬ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে এবার আরও বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিতে চায় অধিদপ্তর।
বর্তমানে দেশে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। সেই হিসাবে ১ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিলেও তা ১ লাখ হওয়া উচিত। সেজন্য আমরা আরও বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিতে সুপারিশ করেছি বলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু নূর মো. শামসুজ্জামান। সবশেষ সাড়ে ৮২ হাজার শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছিল। আগামীতে সেটি ১ লাখ বা তারও বেশি হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক স্তরে আবার বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেও এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অনেক শিক্ষাবিদ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা। তাদের মতে, বৃত্তি পরীক্ষা বাস্তবে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। এটি শিশু বিকাশেরও পরিপন্থি। এতে বিভাজনও তৈরির আশঙ্কা আছে।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল। তারা এরই মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরামর্শক কমিটির প্রধান ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ। তিনি প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা ফেরানোর পক্ষে নন।
অধ্যাপক মনজুর আহমদ মনে করেন, ‘অভিভাবকদের সাধারণ ধারণা হলো বৃত্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ালেখা করে। এতে শিক্ষার মানও বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। এ পরীক্ষা নিলে বরং ক্ষতি হবে। তাই এ পরীক্ষা না নিয়ে সামগ্রিকভাবে সমতা ও গুণগত মান উন্নত করার জন্য পরামর্শক কমিটির যেসব সুপারিশ আছে, সেগুলোতে নজর দেওয়া দরকার।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দেখবেন, বিদ্যালয়গুলোতে কেবল যারা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারে, এমন শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকরা বেশি মনোযোগ দেন। এতে সমতা নয়, বৈষম্য তৈরি হয়। এলাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের অনেক সময় বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয় না। বলা হয়, বৃত্তি পরীক্ষা দিতে অনেক নোট-গাইড বই ও প্রাইভেট-কোচিং করা প্রয়োজন। যাদের পরিবারের সামর্থ্য নেই তাদের পরীক্ষা দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। সেজন্য এলাকাভিত্তিক দরিদ্র নির্ধারণ করে উপবৃত্তির ওপর জোর দেওয়া দরকার।’
তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এতে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে আগে থেকে বিশেষ পরিচর্যা করা হয়। তারাই বৃত্তি পরীক্ষা দেয়। বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো দেখানোর জন্য শিক্ষকরা বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়া গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তাছাড়া মফস্বলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধনী বা সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের এ ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের নিরুৎসাহিত করা হয়। তাই বৃত্তি পরীক্ষায় বৈষম্য তৈরি হয় বলে মনে করেন সেজন্য তারা বৃত্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন।