শিরোনাম:
গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা নিহত, পুরুষ শূন্য গ্রাম।

মোঃ আছমত আলী
- আপডেট সময় : ১১:৪২:০১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫ ১৩৬ বার পড়া হয়েছে
মোঃ আছমত আলী, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা নিহত পুরুষ শূন্য গ্রাম, চাতলপাড় জুড়ে এখন লুটেরাদের আতঙ্ক।
প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে বাড়িঘর
পোড়ার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
স্কুল ছেড়েছে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী
গ্রাম ছাড়া শতাধিক পরিবার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল নেতা সোহরাব মিয়া হত্যাকাণ্ডের পর চাতলপাড় ইউনিয়ন এক ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয়েছে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে বাড়িঘর, চলছে অবাধে লুটপাট। গ্রেপ্তার এড়াতে এবং পাল্টা হামলার ভয়ে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে পুরো এলাকা। নারী ও শিশুসহ গ্রাম ছেড়েছে শতাধিক পরিবার। কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রামে এখন কেবলই নারী ও শিশুদের হাহাকার আর পোড়ার গন্ধ আর পোড়ার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
গত শনিবার (৫ জুলাই) মোল্লা গোষ্ঠী ও উল্টা গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে চাতলপাড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহরাব মিয়া (২৬)নিহত হন। এ ঘটনার পর থেকেই পুরো ইউনিয়নে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে শুরু হয় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে ছিটে আছে ভাঙা কাচ, পোড়া টিন আর লণ্ডভণ্ড আসবাবপত্র। কয়েকটি বাড়িতে এখনও ধোঁয়া উড়ছে।
অসহায় সাফিয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, “আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায়। কিন্তু মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন আমার ঘরটা পুড়িয়ে দিল। আমার একটা ছেলে সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘরটা তুলেছিল। আজকে আমার সব শেষ।”
ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম বলেন, “আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করিনি। তারপরও আমার বাড়িতে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন হামলা করে সব ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন খেতে ঘুমাই। তিন দিন ধরে খাবারও নেই। বাড়িতে এসে পানি খাব, হামলাকারীরা ঘরের চুলা এমনকি পানির টিউবওয়েলটিও তুলে নিয়ে গেছে।
অন্তঃসত্ত্বা কুহিনূর বেগম বলেন, “আমি অসুস্থ। আমায় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলা থেকে স্বর্ণালংকার লুট করে ঘরে থাকা সবকিছু নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ওষুধগুলোও নিয়ে গেছে। বারবার অনুরোধ করার পরও আমার হাত-পা বেঁধে রেখে চলে যায়।”

সখিনা বেগম নামে আরেক বৃদ্ধার কথায় ছিল কেবলই অসহায়ত্ব আর ভয়। তিনি বলেন, “সবকিছু চোখের সামনে পুড়তে দেখলাম। বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ছেলেরা ভয়ে পালিয়েছে। আমরা কই যাব, কী খাব, কিছুই জানি না।”
সংঘর্ষ ও প্রাণহানির প্রভাব পড়েছে এলাকার শিক্ষাব্যবস্থায়। কাঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০০ জনের বেশিই অনুপস্থিত। প্রাণভয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২১ শিক্ষার্থী প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। কেবল শিক্ষার্থী নয়, আতঙ্কে একজন শিক্ষকও ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে আছেন। প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম বলেন, “শিক্ষার্থীরা তো বটেই, শিক্ষকরাও আতঙ্কে আছেন। অভিভাবকদের ফোন করেও সাড়া পাচ্ছি না।”
শুধু ঘরবাড়িই নয়, হামলাকারীদের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি চাতলপাড় বাজারের চালের আড়ত, মোবাইল ও বিকাশের দোকান এবং রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, দোকানগুলো থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল লুট হয়েছে। হামলাকারীদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি কৃষকের ধান ও গরু।
ব্যবসায়ী হামজা ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, “আমার ২৫ লাখ টাকা ও দোকানের সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাতলপাড় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মোতাহার মিয়া (মোল্লা গোষ্ঠী) ও যুবদলের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিনের (উল্টা গোষ্ঠী) মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর নিহতের ভাই মোজাহিদ মিয়া বাদী হয়ে নাসিরনগর থানায় মামলা করেছেন। মামলায় মো.গিয়াস উদ্দিন,মো. আফসর মিয়া,শরীফ মিয়াসহ ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মোল্লা গোষ্ঠীর গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করেন, তাদের গোষ্ঠীর অন্তত পাঁচজনের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ৪০টির বেশি বাড়িতে লুটপাট চালানো হয়েছে। হামলা থেকে রক্ষা পায়নি স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও জাসাসের নেতাদের বাড়িঘরও।
এদিকে, নিহতের ভাই মোজাহিদ মিয়া ভাইয়ের হত্যার বিচার চেয়েছেন এবং প্রতিপক্ষের বাড়িতে লুটপাটে নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চাতলপাড় ফাঁড়ি পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন,”আমাদের জনবল কম এবং যাতায়াতের সুবিধা নেই। তাই ওই এলাকায় যাওয়া কঠিন। লুটপাটের সময় নিহতের স্বজনরা টেঁটা-বল্লম নিয়ে পাহারা দেওয়ায় আমাদেরও নিরাপত্তা নেই।”
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসহাক মিয়া জানান, দ্রুত শিক্ষা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে স্কুলে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।