শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা.
- আপডেট সময় : ০৯:৫৫:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫ ২২৪ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা.
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা আজ আর আড়ালে রাখার মতো কোন বিষয় নয়; বরং এটি আমাদের
জন্য একটি নগ্ন বাস্তবতা, যা প্রতিনিয়ত জাতির ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে
শিক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগের সময় আমরা দেখলাম যে, এ দেশে এমন একজন শিক্ষাবিদকেও খুঁজে পাওয়া গেল
না, যিনি নিরপেক্ষভাবে যোগ্যতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে এ দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত বলে
বিবেচিত হতে পারেন। সর্বশেষ যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁকে সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্নে ঘিরে ধরে এমন
সব মন্তব্য করতে বাধ্য করছেন, যা মূলত ‘শুনতে ভালো শোনায়’। কিন্তু শিক্ষার মতো একটি জটিল,
গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত খাতে আসল চাহিদা হচ্ছে জনপ্রিয় বুলি নয়; বরং দরকার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও
লক্ষ্য, সুসংহত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং নানা মেয়াদি অব্যাহত কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং সেই
অনুযায়ী কাজ করা।
গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘দ্যা রিপাবলিক’-এ শিক্ষার লক্ষ্যকে রাষ্ট্রগঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে
চিহ্নিত করেছিলেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় কেবল জনপ্রিয় স্লোগান দেওয়া বা সাময়িক সংকট
ঠেকানো, তবে তার ফল হবে লেবাসধারী ও অস্থায়ী। রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের জন্য আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থায় এই ভ্রান্তি বহু দশক ধরে চলে আসছে। সরকার পরিবর্তনে প্রতিবার নীতি পরিবর্তন,
কাঠামোগত সংস্কার কিংবা নতুন পরামর্শকের নিয়োগ কেবল রাজনৈতিক সুবিধা বা তাৎক্ষণিক তুষ্টির
জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ প্রকৃত সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ,
জরুরি ও স্বল্পমেয়াদি সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি রূপকল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার
বাস্তবায়ন। অন্যথায় শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ রূপান্তর করে আমরা যে ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’
রাষ্ট্রগঠনের প্রত্যাশা করি, তা কখনোই পূর্ণতা পাবে না।
২০১২ সালের শিক্ষাক্রম যেভাবে হুট করে বাতিল করা হয়েছিল, তেমনি বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমও
একই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। এ ধরনের একক সিদ্ধান্তনির্ভর আচরণ শিক্ষার সংস্কৃতিতে একটি
দুষ্টচক্রের জন্ম দিয়েছে, যা শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বদলে দিন দিন আরও দুর্বল করে
তুলেছে। শিক্ষা সংস্কার তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন তা দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ
ও অংশীজনদের মতামত নিয়ে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশে
সংস্কারের নামে বারবার জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের খাতিরে, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক
জনতুষ্টির লক্ষ্যে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষানীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে পরীক্ষামূলক এক
ল্যাবরেটরি, যেখানে শিক্ষার্থীরা বারবার অকার্যকর ও অস্থায়ী পরীক্ষার শিকারে পরিণত হয়েছে।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন কোনো ‘চটপট’ (শর্টকাট)
প্রক্রিয়া নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকতা, বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস।
জনমোহন সিদ্ধান্ত যেমন তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দেয়, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে তা দেশ ও জাতির জন্য
সর্বনাশ ডেকে আনে। বাস্তবে যেকোনো রোগ সারাতে হলে অনেক সময় তিতা ওষুধ গিলতে হয়। তাই বলে এই
প্রাচীন সত্যটি উপেক্ষা করলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তাই
সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য যদি আমরা তিক্ত বাস্তবতা মেনে না নিতে পারি, তবে সংস্কারের নামেই
আবারো নতুন ব্যর্থতার বীজ বপন করা হবে। পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখা জরুরি যে, বারবার
নীতিগত উলটপালট শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেই বিপর্যস্ত করছে না, বরং পুরো সমাজকে এক
অনিশ্চয়তা, এমনকি বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ভূমিকা নিয়ে
দ্বিধায় ভুগছে, শিক্ষকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরা আস্থা হারিয়ে হচ্ছে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা।
এই অনিশ্চয়তা কেবল শিক্ষাব্যবস্থাকেই নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রগঠনের জন্য প্রথম শর্ত হলো সুশিক্ষিত নাগরিক। তাঁর দৃষ্টিতে,
শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের উপায় নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের ভিত্তি। একইভাবে মুসলিম
সমাজতত্ত্ববিদ ইবনে খালদুন শিক্ষা ও সভ্যতার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, জ্ঞান
উৎপাদন ও তার সঠিক প্রয়োগ ছাড়া কোনো সমাজ অগ্রসর হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী যে, যেখানে
জ্ঞানচর্চা অবহেলিত হয়েছে, সেখানে সমাজ কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর যেখানে জ্ঞানকে রাষ্ট্রীয়
নীতির কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, সেখানে সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। আজও বিশ্বব্যাপী সেই সত্য অক্ষুণ্ণ
রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে: শিক্ষা পরিকল্পনায় বাংলাদেশ কোন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছে? সামাজিক
চাহিদা পূরণের কৌশল (সোসাল ডিমান্ড এপ্রোচ), শ্রমবাজারের প্রয়োজন মেটানোর পদ্ধতি (ম্যানপাওয়ার
রিকোয়ারমেন্ট এপ্রোচ), নাকি ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণের হিসাব (কস্ট-বেনিফিট এপ্রোচ)? নাকি এগুলোর
সমন্বিত কোনো রূপ, যা সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতির সামগ্রিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে পারে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।
বরং জাতীয় শিক্ষানীতির নামে রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠিত অস্থায়ী শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত
চাপিয়ে দেওয়া এবং জনসাধারণকে অন্ধকারে রাখার প্রবণতা বেশি প্রকট হয়ে উঠছে।
আধুনিক শিক্ষা-তত্ত্ববিদরা দেখিয়েছেন যে, শিক্ষা নীতির সাফল্য নির্ভর করে নীতির স্বচ্ছতা,
অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর। জনগণের অজান্তে বা আস্থার বাইরে
কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে তা টেকসই হয় না। এর মূল কারণ সেই নীতিতে থাকে না গণ-
আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কিংবা তার থাকে না গণসমর্থনের ভিত্তি। তাই জনগণের আস্থা অর্জন এবং
বাস্তব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাসংস্কার ছাড়া টেকসই অগ্রগতি অসম্ভব। শিক্ষাক্রম
প্রণয়নের আগে সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা জরুরি। আর সেটা হলো: শিক্ষার
উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্যের স্বচ্ছ সংজ্ঞা ছাড়া যে কোনো শিক্ষাক্রমই কেবল খণ্ডিত প্রয়াস হয়ে থাকবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার পুনর্বিন্যাস যদি শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারকে
লক্ষ্য করে করা হয়, তবে তা সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। আবার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে
নির্দিষ্ট কোনো খাতে ব্র্যান্ডিং করার প্রচেষ্টাও দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাকে সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ করে
ফেলতে পারে। প্রযুক্তিগত (টেকনিক্যাল) বা পেশাগত (ভোকেশনাল) শিক্ষার কাঠামো কি বাস্তব শিল্প-
অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে, নাকি কেবল কাগুজে নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ?
এ প্রশ্নের উত্তর আজও আমাদের কাছে অস্পষ্ট।মূলধারার সাধারণ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়েও বিতর্ক রয়ে গেছে। এটি কি কেবল বিশেষ কাজের বা
পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃত মানবিক
চেতনা, সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বশীল নাগরিকত্ব গঠনে কাজ করবে? বিশ্বের উন্নত
শিক্ষাব্যবস্থাগুলো দেখিয়েছে যে, কেবল শ্রমবাজারের জন্য দক্ষতা নয়, বরং সৃজনশীল, সমস্যা সমাধানে
সক্ষম ও নৈতিক মানুষ তৈরি করাই শিক্ষানীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর
কালজয়ী ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে,
শিক্ষার কাজ কেবল পেশার প্রস্তুতি নয়, বরং মানুষকে পূর্ণ মানুষ করে তোলা। আজকের
নীতিনির্ধারকদের সেই দিকনির্দেশণার আলোকে নিজেদের অবস্থান নতুন করে পর্যালোচনা করা
অপরিহার্য। পাশাপাশি শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন দার্শনিক জন ডিউইয়ের কথা মনে রাখা যায়। তিনি
বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা হলো সমাজের পুনর্গঠনের প্রধান হাতিয়ার। যদি শিক্ষা শুধুই চাকরির
প্রস্তুতিমূলক হয়, তবে সমাজ থাকবে স্থবির ও সংকীর্ণ। আর যদি শিক্ষা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা
করতে শেখায়, তবে সেই সমাজে জন্ম নেবে সৃজনশীলতা, মানবিকতা, সমতা এবং ন্যায়বোধ। সুতরাং,
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য নির্ধারণে নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন দুটি পথ খোলা রয়েছে-
হয় সংকীর্ণ দক্ষতা সরবরাহে আটকে থাকা, নয়তো বিস্তৃত মানবিক রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি রচনা করা।
প্রায়োগিত অর্থে একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তিতে
হওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বড় সংকট হলো চাহিদা ও
জোগানের মধ্যে গুরুতর অমিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তরুণদের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার
প্রতি বিপুল আগ্রহ থাকলেও, দেশে চিকিৎসা কলেজে আসন সংখ্যা সীমিত। এর ফলে অসংখ্য মেধাবী
শিক্ষার্থী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ দেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার সংকট
দীর্ঘদিন ধরেই প্রকট; গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসক সংকট যেন এক অব্যাহত অভিশাপ।
অন্যদিকে এলাকা ভেদে রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বল্পমেয়াদি জনপ্রিয়তার খাতিরে অকারণে নতুন নতুন
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক, গবেষণাগার কিংবা অবকাঠামোগত সক্ষমতা
নেই। ফলে একদিকে সম্পদের অপচয় ঘটছে, অন্যদিকে জাতীয় প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে না। উন্নয়ন
অর্থনীতির গবেষণাগুলো বারবার প্রমাণ করেছে যেখানে শিক্ষা পরিকল্পনা শ্রমবাজারের বাস্তব চাহিদার
সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেখানে শিক্ষিত বেকারত্ব অনিবার্যভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশও এখন সেই
সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, স্নাতক ডিগ্রিধারীদের একটি বড় অংশ
উপযুক্ত কর্মসংস্থানের বাইরে থেকে যাচ্ছে, অথচ বিশেষ খাতগুলোতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি প্রকট
আকার ধারণ করছে।
এই বৈসাদৃশ্য কেবল ব্যক্তিগত হতাশা নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির জন্যও এক গভীর হুমকি। যুবসমাজ
যখন সনদধারী শিক্ষিত হয়েও বেকার থাকে, তখন তা সামাজিক অস্থিরতা, মেধা পাচার ও রাজনৈতিক
অশান্তি বাড়িয়ে তোলে। ইতিহাসে দেখা গেছে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই
শিক্ষা পরিকল্পনার এই ভুলে দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও সামাজিক অস্থিরতার শিকার
হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে এখন একই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনার
সাথে মিল রেখে সঠিক শিক্ষা পরিকল্পনা ও শ্রমবাজারের চাহিদার সাথে সমন্বয় ছাড়া উন্নয়নের টেকসই
পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো শিক্ষা-সংক্রান্ত দপ্তর ও
অধিদপ্তরগুলোতে যোগ্য ও দূরদর্শী মানুষকে দায়িত্বে বসানো। বিশেষ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) বারবার মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ভাঙচুর
না করে বরং এটিকে একটি শক্তিশালী ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। যোগ্যতার
ভিত্তিতে দক্ষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে, যারা পরিকল্পনা, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষাদান পদ্ধতির
আধুনিকীকরণ ও মূল্যায়নসহ সবকিছুকে সমন্বিতভাবে বুঝে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন। শুধু
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা দিয়ে কাউকে ‘পাঠদান পদ্ধতির বিশেষজ্ঞ’ (পেডাগজি
এক্সপার্ট) বানিয়ে দেওয়া চলবে না। শিক্ষাবিদ মানে কেবল বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানদাতা নন, বরং এমন
একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি যিনি শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, দর্শন, নীতি, প্রয়োগ এবং মূল্যায়ন
সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখেন এবং সেসবের বাস্তবে প্রয়োগে অভিজ্ঞ।
চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতে, ‘আপনি আগামী বছরের জন্য পরিকল্পনা করেন তবে ধান রোপণ
করুন; যদি দশ বছরের জন্য পরিকল্পনা করেন তবে গাছ লাগান; কিন্তু যদি আজীবনের জন্য পরিকল্পনা
করেন তবে মানুষকে শিক্ষা দিন’। এই চিরন্তন উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষা হলো দীর্ঘমেয়াদি
বিনিয়োগ, যা একটি জাতির সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। কিন্তু সেই শিক্ষাকে সময়োপযোগী করতে
হলে প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা। এখানে আরও একটি
বিষয় প্রাসঙ্গিক যে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক চাপে দুর্বল না
করে বরং স্বশাসিত করে তোলা হয়। যেমন ফিনল্যান্ড বা জাপানে শিক্ষানীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা,
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য এবং বিশেষজ্ঞদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশেও যদি শিক্ষাকে
সত্যিকারের অগ্রাধিকার দিতে হয়, তবে প্রথম শর্ত হবে শিক্ষাক্ষেত্রের নেতৃত্বে যোগ্যতা, সততা ও
দায়বদ্ধতাকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একটি সমন্বিত ও ধারাবাহিক
শিক্ষাক্রম প্রণয়ন। শিক্ষা ব্যবস্থা যদি খণ্ড খণ্ড উদ্যোগের ওপর দাঁড়ায়, পরে যতই জোড়া লাগানোর
চেষ্টা করা হোক না কেন, তা কখনোই কার্যকর ফল দিতে পারে না। একটি শক্ত ভিত্তি ছাড়া কোনো
স্থাপনা যেমন টেকসই হয় না, তেমনি শিক্ষার ভিত্তি যদি ভেঙে-চুরে তৈরি হয়, তবে উচ্চশিক্ষা বা কারিগরি
শিক্ষাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন হতে হবে ধীরেসুস্থে, সুপরিকল্পিতভাবে এবং
সুস্পষ্ট সময়সীমার ভিত্তিতে যেখানে থাকবে জরুরি পদক্ষেপ, স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য, মধ্যমেয়াদি কাঠামো
এবং দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প। কারণ একটি ভালো পরিকল্পনা মানেই কাজের অর্ধেক সমাধান হয়ে যাওয়া।
ইতিহাসে এ বিষয়ে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত
অবস্থা থেকে তারা পুনর্গঠনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শিক্ষাকে গ্রহণ করেছিল। পরিকল্পিত শিক্ষা
সংস্কারের ফলেই জাপান শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বনেতায় পরিণত হয়। তাদের
সাফল্যের পেছনে ছিল শিক্ষার কাঠামোগত ধারাবাহিকতা, নীতি-নির্ধারণে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি এবং
সমন্বিত জাতীয় প্রচেষ্টা। বাংলাদেশও চাইলে জাপানের সেই অভিজ্ঞতাকে অনুসরণীয় উদাহরণ হিসেবে
গ্রহণ করতে পারে। তবে এজন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যোগ্য নেতৃত্ব, এবং শিক্ষাকে সর্বাগ্রে
অগ্রাধিকার দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি।
একইসঙ্গে মনে রাখা জরুরি যে, পরিকল্পনার শক্তি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ নয়; তার কার্যকারিতা
নির্ভর করে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর। তাই সমন্বিত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পাশাপাশি কার্যকর মূল্যায়ন
পদ্ধতি, পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং অবকাঠামোগত সহায়তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। না হলে
পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নের পথে শিক্ষাব্যবস্থা বারবার হোঁচট খাবে। সবশেষে মনে রাখতে হবে,
কোভিড-১৯ মহামারির অভিজ্ঞতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) আবির্ভাব-
পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার দর্শন, ধারা ও কাঠামোয় মৌলিক রূপান্তর ঘটেছে। অনলাইন শিক্ষা,
দূরশিক্ষণ, ডিজিটাল দক্ষতা এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রসার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে
দিয়েছে যে, কোভিডপূর্ব শিক্ষা পরিকল্পনা দিয়ে আর বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে চালানো সম্ভব নয়।
বাস্তবতা হলো, আজকের বিশ্বে শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তক ও শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং
তা হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতিমূলক। এ
প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতেও নতুন দিগদর্শনের প্রয়োজন। যদি নীতিনির্ধারকরা
দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসেন, শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেন, পরিকল্পনায়
স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সমন্বিত করেন এবং সর্বোপরি জনস্বচ্ছতা বজায় রাখেন, তবে
শিক্ষাসংস্কার কার্যকর রূপ পাবে। অন্যথায় আমরা পুরনো কাঠামোর ভেতরে নতুন সমস্যার ভার চাপিয়ে
শিক্ষাকে আরও জটিল করে তুলব। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
জন্য শুধু আকাঙ্ক্ষা নয়, টিকে থাকার পূর্বশর্ত। ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ একটি কল্যাণমুখী
রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে স্বপ্ন ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা জাতির সামনে এনেছিল, শিক্ষাসংস্কারের
মাধ্যমেই তার বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব। এজন্য দরকার যোগ্য শিক্ষাবিদ, দূরদর্শী পরিকল্পনা,
রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ। তাই শিক্ষাসংস্কারে লুকোচুরি নয়, চাই সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য
ও লক্ষ্য, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প। তাহলেই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে
একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে পারবে।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।














