যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
- আপডেট সময় : ১২:০৪:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৭৫ বার পড়া হয়েছে
যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
আজ সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘শিক্ষকতা পেশা: মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’, যা শিক্ষকদের সম্মান, পেশাগত মর্যাদা ও যৌথ দায়িত্বের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে।
জানা যায়, বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সূচনা হয় ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে। তবে, এর আগে ১৯৯৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।
একজন শিক্ষক কেবলমাত্র পাঠদানই করেন না, বরং শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা, নৈতিকতা ও ভবিষ্যৎ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকরাই জাতিকে গড়েন, সেইসঙ্গে আলোকিত সমাজ নির্মাণে রাখেন নেতৃত্বের ভূমিকা।
শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা, অধিকার এবং উন্নত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশার প্রতি তরুণদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করা এই দিবসের অন্যতম তাৎপর্য।
দিবসটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক সংগঠন এবং শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে র্যালি, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সম্মাননা অনুষ্ঠান।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি শিক্ষকদের প্রতি জাতির সম্মান, তাদের অধিকার ও পেশাগত উন্নয়নের গুরুত্ব পুনরায় তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।
নিম্ন বেতন, পদে পদে বঞ্চনা, পেনশন নিয়ে হয়রানি ও সামাজিক মর্যাদার সংকটে দেশের শিক্ষকরা। যে কারণে ক্লাসরুম ছেড়ে শিক্ষকদের নামতে হচ্ছে রাজপথে। পদে পদে শিক্ষকদের এমন বঞ্চনায় তলানিতে নামছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের মান-মর্যাদা না বাড়িয়ে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য সেভাবে ভাবেনি। যে কারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় দৈন্যদশাও কাটেনি। এমন বাস্তবতার মধ্যদিয়েই দেশে আজ রোববার (৫ অক্টোবর) পালিত হবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শিক্ষকতা পেশা: মিলিত প্রচেষ্টার দীপ্তি’।
দেশে হাজারও শিক্ষক রয়েছেন, যারা এখনো বেতন ছাড়াই শিক্ষকতা করছেন। মাদরাসাগুলোতে নামমাত্র যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে সংসারও চলে না। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এক অর্থে সরকারিকরণ হলেও আমাদের এসব শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন।
মাধ্যমিকের ৯৩ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের বাইরে রয়েছে। এমন বাস্তবতায় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরি জীবন শেষের ৪-৫ বছরও নিজের জমানো পেনশনের অর্থ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। দেশের বেসরকারিপর্যায়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে শিক্ষকদের বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের চেয়েও কম। আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় রাজনীতি, গবেষণা বিমুখতা কার্যত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলছে।

প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী!
প্রাথমিকেই শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। কিন্তু যারা সেই ভিত রচনা করেন, সেই শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। বেতন গ্রেড ১৩তম। অন্যদিকে মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস একজন ড্রাইভারের গ্রেড ১২তম। সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা এবং বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সর্বসাকূল্যে পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো।
প্রাথমিকের শিক্ষকরা বলছেন, প্রায় সব শিক্ষক ঋণে জর্জরিত। কারণ এই বেতনে একজন শিক্ষক পরিবারের ভরণপোষণ ঠিকমতো করতে পারেন না।
সবচেয়ে বেশি বেতন পান দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের শিক্ষকরা। দেশটির প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট, শ্রীলংকায় ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট। ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতন কাঠামো নিয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ২৮৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এছাড়া ভুটানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন ৩৪১ ডলার ৭২ সেন্ট এবং নেপালে ৪৬৭ ডলার ৪৫ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও শিক্ষকদের গড় বেতন ১৮৯ ডলার ২২ সেন্ট।
সারা দেশে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। তারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় বিগত সময়ে বিভিন্ন দাবি তুলেছেন; কিন্তু সেগুলো পূরণ হয়নি। বেতন কাঠামো দশম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিতে প্রায়ই তারা সড়ক অবরোধ, অনশন ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করছেন।

পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষকতা একটি মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানজনক পেশা। শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতনও উচ্চতর স্কেলে দেওয়া হয়। শিক্ষকেরা আর্থিক সুবিধা ছাড়াও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও মর্যাদা এখনো সেইভাবে রাষ্ট্র দিতে পারেনি। এ জন্যই শিক্ষকেরা এখনো সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি।
মাধ্যমিক পর্যায়ে বেতন সাড়ে ১২ হাজার, নামমাত্র বাড়িভাড়া
মাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরিজীবনে প্রবেশ করছেন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে। এর সঙ্গে পান নামমাত্র বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা। অবসরের পর বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও মেলে না অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা। শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদার এ সংকট শিক্ষাব্যবস্থায় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।
জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন। সরকারি একটি অংশ তাদের বেতনে যুক্ত হলেও বাড়িভাড়া হিসেবে নামমাত্র টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। বর্তমানে একটি প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসক দেখানোর ভিজিট ১০০০-১৫০০ টাকা, সেখানে এসব শিক্ষকের বাড়ি ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে দেওয়া হয় মাত্র ১০০০ টাকা। যা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরা নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেন। শিক্ষকদের এ কষ্ট দেখার কেউ নেই। রাজনৈতিক সরকার হোক কিংবা অরাজনৈতিক সরকার; কেউ শিক্ষকদের মান-মার্যাদা বাড়ানোর দিকে নজর দেয় না। মুখে সবাই শিক্ষকতাকে মহান পেশা বললেও বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য বিষয়ে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের একটাই দাবি, দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষকদের যে চরম বৈষম্য নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে হচ্ছে, তা নিরসন করতে হবে।’














